
বৈশ্বিক খাদ্য সংকট
বৈশ্বিক খাদ্য সংকট: আর্জেন্টিনা রপ্তানি শুল্ক ,ভােজ্য তেলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ,মধ্যপ্রাচ্যের ওপর ইউরােপে চাপ,উপমহাদেশে।

বৈশ্বিক খাদ্য সংকট : মৌলিক চাহিদার প্রথম ও প্রধান উপাদান খাদ্য, যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় মনুষ্য-সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াকলাপ। আভিজাত্যপূর্ণ জীবন না হলেও চলে, কিন্তু না খেয়ে থাকার কোনাে সুযােগ নেই। পৃথিবীজুড়ে বিরাজমান যুদ্ধবিগ্রহ, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, নৈরাজ্যসহ এমন নানান কারণে চরম অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে খাদ্য উৎপাদন, বণ্টন ও বিনিময় প্রক্রিয়া।
বিশ্ববাজারে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রব্যমূল্য এবং সেই সঙ্গে আমদানি-রপ্তানিতে যুক্ত হচ্ছে অতিরিক্ত শুল্কব্যবস্থা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট সংকট আন্তর্জাতিক খাদ্যবাজারকে রীতিমতাে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কার পর্যন্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে তাকালেই আমরা এর প্রভাব উপলব্ধি করতে পারি। দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী অবস্থান দরিদ্রদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তদেরও ভােগাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে উভয় দেশের আমদানি-রপ্তানিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরােধ চলছে। ফলে খাদ্য আমদানির জন্য এই দুদেশের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলাে পড়েছে চরম বিপাকে।
আর্জেন্টিনা রপ্তানি শুল্ক
আর্জেন্টিনা তাদের রপ্তানি শুল্ক আগের চেয়ে বৃদ্ধি করেছে, যার ফলে তৎসংশ্লিষ্ট আমদানিনির্ভর দেশগুলাের খরচ অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। একই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। এভাবে প্রথম বিশ্ব ও স্বল্পোন্নত দেশগুলােতে খাদ্য আমদানিরপ্তানিতে সৃষ্ট অব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ বিশ্ববাজারকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছে। এই গরি বাইরে নয় স্বয়ং বাংলাদেশও, যেখানে আন্তর্জাতিক সংকট প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই)
তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে গম, ভােজ্য তেল, সার ও ভুট্টাজাতীয় পণ্যের উৎপাদন ও বিনিময়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল তথা ভাত হলেও, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গম। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্যসচেতনতার কারণে দেশের বৃহৎ অংশের চাহিদায় স্থান পেয়েছে গম। তবে গমের বার্ষিক চাহিদার মাত্র এক-চতুর্থাংশ উৎপাদন করতে পারে বাংলাদেশ। গমের অবশিষ্ট চাহিদা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করার মাধ্যমে মেটানাে হয়।
গম উৎপাদনের ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে থাকা রাশিয়া ও ইউক্রেন তাদের যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে উৎপাদন ও বণ্টন পুরােপুরি বন্ধ রেখেছে। যার ফলে বাংলাদেশ গম আমদানির ক্ষেত্রে চরম সংকট মােকাবিলা করতে যাচ্ছে। তবে ইন্টারন্যাশনাল গ্র?cযাইন কাউন্সিলের (আইজিসি) প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমান অর্থবছরে ভারতের উদ্বৃত্ত গমের পরিমাণ হবে প্রায় চব্বিশ মিলিয়ন টন।
এ ক্ষেত্রে সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র বাংলাদেশ তার গমের চাহিদা মেটাতে ভারতের কাছ থেকে কিছুটা সুবিধা নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ভারত তার কত শতাংশ উদ্বৃত্ত শস্য রপ্তানিতে আগ্রহী এবং এর মূল্য নির্ধারণে কোনাে অসামঞ্জস্য রয়েছে কি না।

ভােজ্য তেলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ বৃহৎ পরিসরে পাম তেল, রেপসিড ও সয়াবিন আমদানি করে থাকে। ইন্দোনেশিয়া থেকে পাম তেল এবং আর্জেন্টিনা থেকে রেপসিড আমদানি করে বাংলাদেশে তা প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
বর্তমানে সম্ভাব্য বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের বিষয়কে বিবেচনায় রেখে ইন্দোনেশিয়া, কাজাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। আর্জেন্টিনা সম্প্রতি তাদের রপ্তানি শুল্ক কিছুটা বৃদ্ধি করেছে, যার ফলে তৈলবীজ আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশেকে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভােজ্য তেলের চাহিদা মেটাতে নতুন উৎসের সন্ধান করতে হচ্ছে।
ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার তৈরি। ‘র্ড স্ট্রিমণ্ড২’ পাইপলাইন বন্ধ থাকার ফলে ইউরােপের তীব্র জ্বালানি সংকট নিরসনে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর চাপ অনেকটা বেড়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের ওপর ইউরােপে চাপ
মধ্যপ্রাচ্যের ওপর ইউরােপের এমন চাপের মুখে জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশও কিছুটা বিপাকে পড়েছে বলে মনে করা হয়। গম, আটা, ভােজ্য তেল ও জ্বালানির পাশাপাশি সার আমদানিতেও চাপের মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে চাষাবাদের অন্যতম অংশীদার সার, যার বৃহৎ অংশের জোগান দেওয়া হয় আমদানির মাধ্যমে। বিশ্ববাজারে সার রপ্তানিতে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শীর্ষ স্থান দখল করে আছে রাশিয়া।
ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার রপ্তানিতে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে এই বাজার অনেকটা অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। সার ছাড়া চাষাবাদ সম্ভব না, আর এর জোগান দিতে নতুন উৎসের সন্ধান করছে বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে আমদানিব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি, যার প্রভাব সরাসরি প্রান্তিক কৃষিতে গিয়ে পড়ছে।
অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি এবং অপর্যাপ্ত জোগানের কারণে সারের ব্যবহার কমে গেলে উৎপাদন স্বভাবতই হ্রাস পাবে। চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ভূমিধস ইত্যাদি কারণে প্রতি বছর জমি নষ্ট হয়ে ধানের উৎপাদন ব্যাহত হয়। এর ফলে ঘাটতি চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ চাল আমদানিতে এক প্রকার বাধ্য হয়।
বিশ্বজুড়ে নানা অচলাবস্থা আন্তর্জাতিক বাজারকে রীতিমতাে অস্থিতিশীল করে রেখেছে, যার প্রভাব আঞ্চলিকপর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি জনজীবন অতিষ্ঠ করে দিয়েছে, যার বাস্তবচিত্র টিসিবি পণ্যের জন্য মানুষের লাইন দেখলেই বােঝা যায়।

উপমহাদেশে
১৯৪৩-এ ১৯৭৪ সালে স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়, যার প্রধান কারণ ছিল অনাবৃষ্টি, বন্যা, খরা, যুদ্ধ পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি। এমন পরিস্থিতিতে তীব্র খাদ্য সংকট তৈরি হওয়া এবং দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়াটা মােটামুটি স্বাভাবিকই বলা যায়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে এ ধরনের কোনাে অসংগতি না থাকা সত্ত্বেও পণ্যের বাজার অনেকটা অস্থিতিশীল। এর অন্যতম কারণ বলা যায় সিন্ডিকেট সদস্যদের দৌরাত্ম্য, যারা জোট বেঁধে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে। প্রান্তিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মধ্যস্বত্বভােগীরা পণ্যের গুদামজাত করে প্রতিনিয়ত লাভবান হচ্ছে।
মধ্যস্বত্বভােগীরা যে পণ্য উপজেলাপর্যায়ে সর্বনিম্ন দামে ক্রয় করে, তা জেলা শহরে এসে তারা চড়া দামে বিক্রি করে। এর ফলে চরম বিপাকে পড়েছে নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। সিন্ডিকেটের তৈরি কৃত্রিম সংকটের ফলে সৃষ্ট দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক উর্ধ্বগতি জনজীবন বিপন্ন করে দিয়েছে।
নােবেল পুরস্কারে ভূষিত প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার, দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষ’ বইতে উল্লেখ করেছেন কীভাবে উদ্বত্ত উৎপাদন থাকা সত্ত্বেও মানুষ না খেয়ে মরতে পারে। এর বাস্তবচিত্র সিন্ডিকেটের তৈরি কৃত্রিম সংকটের দিকে তাকালেই স্পষ্ট বােঝা যায়। তিনি উল্লেখ করেছেন পণ্যের সহজলভ্যতা নয়, বরং ব্যক্তির ক্রয়ক্ষমতা ও প্রয়ােজনীয়তার দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তবেই পণ্য উৎপাদন, বণ্টন ও বিনিময়ে ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে।